«

»

ফেব্রু. 22

ফটোগ্রাফী লেকচার – ৭: পর্যবেক্ষন এবং চিন্তার প্রয়োগ

কোর্সের মূল পাতা 

রেজিস্ট্রেশনের লিংক – এখানে ক্লিক করে কোর্সে রেজিস্ট্রেশন করে নিন। এই কোর্সটি সম্পূর্ণ বিনা মূল্যের।

প্রথম লেকচারের লিংক:- ফটোগ্রাফী: ভূমিকা

দ্বিতীয় লেকচারের লিংক:- ফটোগ্রাফী: ক্যামেরা

তৃতীয় লেকচারের লিংক:-ফটোগ্রাফী: লেন্স

চতুর্থ লেকচারের লিংক –ফটোগ্রাফী: আলো এবং এক্সপোজার

পঞ্চম লেকচারের লিংক –ফটোগ্রাফী: কম্পোজিশন এবং মুহুর্ত – ১

ষষ্ঠ লেকচারের লিংক –ফটোগ্রাফী: কম্পোজিশন এবং মুহুর্ত – ২

 

 

ডিম আগে নাকি মুরগী আগে?

আমরা আসলে সেই চিরন্তন প্রশ্নের আর একটি সমাধানের চেষ্টা করছিনা এখানে। এই প্রসঙ্গের অবতারণা শুধু মাত্র ফটোগ্রাফীর সেই বহুল আলোচিত প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য – ছবি তুলে চিন্তাভাবনা করবো, নাকি চিন্তাভাবনা করে ছবি তুলবো?

ফটোগ্রাফারের বিবর্তন ঘটে সময়ের সাথে সাথে। শিশু যেমন দাঁত ওঠার সাথে সাথে সব কিছুই কামড়ে দেখতে চায়, নবীন ফটোগ্রাফার শাটার চাপা শেখার সাথে সাথে সব কিছুরই ছবি তুলতে চায়। মানুষ, ফুল, পাখি, বিল্ডিং, পোকামাকড় ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার প্রথম দিককার ফ্যাসিনেশন ছিল ফুল আর ল্যান্ডস্কেপ। সুন্দর ফুল দেখলে সেটার একটা ছবি তুলে ফেলতাম, গ্রামে গেলে শুধু তুলতাম পেঁজা-তুলো মেঘে ঢাকা আকাশ আর টলমলে নদীর ছবি। মাঝে মাঝে গরুর গাড়ি এবং মুরগীর বাচ্চার ছবিও তুলতাম – যদিও মানুষের ছবি তোলার প্রতি আগ্রহ একেবারেই ছিল না। যেটা বলতে চাচ্ছি, সেটা হলো ফটোগ্রাফীতে চিন্তার ভূমিকাটা বুঝতে একটু সময় লাগে। আর এখন ডিজিটাল যুগ হয়ে ব্যপারটা আরো জটিল হয়ে গেছে। ফিল্মের সময়কালে ফটোগ্রাফারদের চিন্তা করে ছবি তুলতেই হতো, কেননা একটা রোলে সর্বোচ্চ ৩৬ টা ফিল্ম থাকতো, আর এতদসংক্রান্ত খরচ তো ছিলই। কাজেই, একটা ছবি ‘তুলব কেন?’ – এই প্রশ্নটা ছিল সবচেয়ে জরুরী। ডিজিটালের যুগে এই প্র্রক্রিয়াটি আমাদের নতুন করে শিখতে হচ্ছে – কেননা এখন হাজারটা ছবিও ৪ গিগাবাইটের একটা কার্ডে দিব্যি এটে যায়।

উপরের আলোচনার শেষ পয়েন্ট টি – ‘ছবিটা তুলবো কেন?’, খুব সম্ভবতঃ ছবি তোলায় ভাল করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটা। তবে এই প্রশ্নের একটা সহজ উত্তর আছে – ‘আমার ভাল লেগেছে, তাই’| এই উত্তর যদি নিজেকে দিতে থাকেন, তাহলে খুব একটা লাভ হবে না । হা হা। আপনি ফুলের ছবি তুলছেন – কিন্তু ছবিটায় কোন বিশেষত্ব আছে কি? ছবিটা কোন স্পেসিফিক মেসেজ দিচ্ছে কি? ছবিটা কি কোন গল্প বলছে? পৃথিবীতে তো এর আগে কয়েক কোটি ফুলের ছবি তোলা হয়েছে। আপনারটা কোন দিক দিয়ে অন্যরকম? আমি কিন্তু ফুলের ছবি তোলা কে খারাপ বলছিনা। কিন্তু ফটোগ্রাফীতে উৎকর্ষ সাধন যদি উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে নিজেকে এই প্রশ্নগুলো করতেই হবে।

The Earth & the Heaven [..Dhaka, Bangladesh..]

এ্কটা ফুলের ছবি। বিশেষত্ব কিছু নেই, কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শিখেছিলাম এই ছবিটা তুলে। ফটোগ্রাফারদের একটা চেষ্টা থাকে ছবিতে লেন্স ফ্লেয়ার জিনিসটি অ্যাভয়েড করার। সরাসরি সূর্যের দিকে তাকালে আমাদের চোখ ধাধিয়েঁ যায়..ক্যামেরার চোখ ধাঁধানো টা কে বলে লেন্স ফ্লেয়ার। উদাহরণ দেখার জন্য নিচের লিংক ভিজিট করুন:

http://www.cambridgeincolour.com/tutorials/lens-flare.htm

এই ছবির পেছনের কোমল আভার কারণ কিন্তু লেন্স ফ্লেয়ার। পরিবেশটা মোটেও এমন ছিলনা। ফুলের দিকে ক্যামেরা তাক করার পর দেখি লেন্সের চোখ ধাঁধিয়ে গিয়ে এই এফেক্ট তৈরী হচ্ছে। ব্যস! শিখে গেলাম, যেটাকে আমরা লেন্সএর ত্রুটি বলি – সেটা অনেক সময় ছবির অলংকারও হতে পারে। কাজেই এই ছবিটি তোলা এবং সেটাকে ধরে রাখার পেছনে আমার একটা কারণ ছিল।

ডিম আগে না মুরগী আগে নিয়ে আরো কিছু কথা। এই প্রশ্নের সম্মুখীন আসলে আমাকে সবসময়ই হতে হয়। আমার মনে হয় চিন্তার ব্যপারটা সবসময়ই আগে আসে। অনেক সময় থট প্রসেসটা এত দ্রুত ঘটে, যে মনে হয় আমরা কোন কিছু ভাবনা চিন্তা না করেই ছবিটি তুলে ফেলেছি। একটা ছবি তোলার পর ছবিতে গুঢ় কোন অর্থ ধরা পড়তে পারে আপনার কাছে, কিন্তু প্রাথমিক অবজারভেশন  ছবি তোলার আগেই সম্পন্ন করতে হয়েছে। নিচের উদাহরণগুলো দেখি:

Life cycle

এই ছবি তোলার জন্য হাতে সময় পেয়েছিলাম বড়জোড় তিন চার সেকেন্ড। প্রথমে আমার চোখে পড়ে মাঝখানের হা করে ঘুমিয়ে থাকা মানুষটি। যতদুর আমার এখন মনে আছে, ওনার এই অদ্ভুত ভঙ্গিটি ক্যামেরা বন্দি করার জন্যই শাটার টিপেছিলাম। আর কিছু মনে নেই। ছবি বের করার পর দেখি শুধু ঘুমন্ত মানুষটিই নয়, একদম পিছনে একজন কপালে হাত দিয়ে বসে আছে! সব মিলে একটা অদ্ভুত কম্পোজিশনের ছবি হয়ে গেল। ছবিটা দেখে আমার তখন মনে হল ‘জীবনচক্র’ ধরনের কিছু একটা..অথবা একটা গল্প যেটা ধীরে ধীরে শাখা প্রশাখা মেলছে (an unfolding story)।

এতদিনের ছবি তোলার অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছি, ‘কিছু একটা আছে এখানে’, এই অনুভুতি যদি হয় কোন একটা বিষয় দেখে, তাহলে সেই মুহুর্তেই ছবিটা তুলে ফেলা উচিত। এইধরনের ‘Instinctive urge’ এর উৎস হয়তো বা অবচেতন মনে – ছবি তোলার পরই কেবল তার প্রকৃত অর্থটা অনুধাবন করা সম্ভব।

প্রচুর চিন্তাভাবনা করে তোলা একটা ছবি:

The dead shrub

তুষারপাতের সময় উপর থেকে রেলিংগুলোর কম্পোজিশন ক্যামেরায় বন্দি করে বসেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশের ‘feel’ কে ধারন করা। অপেক্ষা করছিলাম একজন মানুষ কখন ফ্রেমে ঢুকবে তার জন্য। ফ্রেমে ঢোকার পরপরই তার পায়ের স্টেপগুলো খেয়াল করে ছবিটা তোলা হয়েছে। তুষারপাতের সময় সাধারণতঃ মানুষ দ্রুত ঘরে ঢুকে যায়, এলাকা জনমানবশুণ্য হয়ে যায়। একজন/দু’জন মানুষকে কদাচিৎ দেখা যায় আশ্রয়ের দিকে ছুটতে। এরকম ‘নিঃসঙ্গ’ একটা তুষারশুভ্র দুপুরই দেখানোর চেষ্টা করেছি।

তাহলে দেখা গেল, ছবি তোলার আগে চিন্তার ব্যপারটিই মুখ্য। আপনি অনেকসময় ছবি তোলার একটা ‘তাড়না’ অনুভব করবেন, সেই তাড়নাকে অবহেলা না করে ছবিটা তুলে ফেলাই ভাল। কিন্তু যখন একটা ‘Out of nowhere’ ধরনের ছবি তুলতে হবে, তখন অনেক চিন্তা করার পরই অর্থবহ কম্পোজিশন করা সম্ভব, নচেৎ নয়। কম্পোজিশন এবং লাইট সম্পর্কে সম্যক ধারণা, প্রচুর ছবি দেখার অভ্যাস এবং আশেপাশের পরিবেশকে সুক্ষভাবে লক্ষ্য করার ক্ষমতা – এই সবই ছবিতোলার ‘Thought process’ এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ক্ষুদ্রের শক্তি

একটা কথা খুব সম্ভব আগেও বলেছি। ফটোগ্রাফীতে আপাতঃ অ-গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তুর গুরুত্ব অপরিসীম। এই বিষয়টি উপলব্ধি এবং সেই উপলব্ধির কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ খুবই জরুরী। আমরা প্রায়শঃই বলি, ‘এখানে ছবি নাই’, ‘ওইখানে ছবি হবে না’, ‘কোন ঘটনাই ঘটছেনা, ছবি তুলবো কিসের?’। এইভাবে যখন আমরা বলি, তখন কিন্তু আমরা স্বীকার করে নেই যে বিষয়বস্তুর গুণেই ছবিটি হতে হবে – তথা ফটোগ্রাফারের ক্ষমতাকে আমরা নিজেরাই অস্বীকার করি। সত্যি কথা বলতে গেলে – সবখানে, সব কিছুরই ছবি হয়। ফটোগ্রাফার তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলণ ঘটানোর জন্য খুব সাধারণ বিষয়বস্তুর আশ্রয় নিতে পারেন, পূর্ণ স্বাধীনতা তার রয়েছে। কিছু উদাহরণের মাধ্যমে ব্যখ্যা করছি কিভাবে সাধারণ বিষয়ও আপনার ছবিতে অনেক সিগনিফিক্যান্ট উপাদান হয়ে উঠতে পারে:

উদাহরণ ১:

Stay for a Moment [..Pabna, Bangladesh..]

দু’টো গ্রামের মেয়ে মাঠে খেলছে। সরাসরি দেখানো যেতো, কিন্তু কম্পোজিশনের উপাদান হিসেবে একটা গাছের পাতার ফাঁক কে ব্যবহার করা হলো। এমনি হয়তো একটা গাছের পাতা কিছু নয়, আশে পাশে শত শত গাছ এবং হাজার হাজার সবুজ পাতা ছিল। কিন্তু এই ছবিতে একটা গাছের ছেঁড়া পাতাই হয়ে উঠলো গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আপনার ছবিতে সেইসব হাজার হাজার পাতা নেই, দর্শক সেটা দেখবেনও না। দর্শকের কাছে এই একটি ছেঁড়া পাতার ফাঁক দিয়ে প্রতিভাত হওয়া গ্রামের চিরন্তন দৃশ্যটিই একমাত্র বাস্তবতা।

উদাহরণ ২:

A hymn to life [..Kuakata, Bangladesh..]

খুব সহজেই ফোরগ্রাউন্ডের লতাগুল্মগুলো ফটোগ্রাফারের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারতো। আফটারঅল, সৈকতে হাজার হাজার এরকম গাছগাছড়া ছিল। শুধু বাচ্চাগুলোকে ফ্রেমে রাখলেই তো ছবির মেসেজটা দেয়া যেত – একতা আর আশার গল্প; United we stand। কিন্তু ছবির গল্পটাকে আরো Diversify করতে এই লতাগুল্মগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে – সবুজ রং এখানে নতুন দিন, নতুন সময়ের প্রতিনিধিত্ব করছে। Symbolism নিয়ে পরের লেকচারে আলোচনা থাকবে। তাছাড়া আর একটি বিষয় খেয়াল করুন – এই গাছগুলো এমনিতে অনেক ছোট, আপনার পায়ের কাছে পড়ে থাকবে। কিন্তু কম্পোজিশনের কারসাজিতে তারা  ফ্রেমের অনেক বড় একটা যায়গা দখল করে আছে। ফটোগ্রাফার চাইলে ইচ্ছেমতন ক্যামেরা অ্যা‌ঙ্গেল এবং ফোকাল লেংথ ব্যবহার করে এই এফেক্টগুলো ছবিতে নিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু তার আগে, ওই যে বললাম – চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি ছবিতে কি চান, কিভাবে চান।

 

কাজেই, ছোটখাট বস্তুকে হেলা করবেন না! ফটোগ্রাফী হলো ফটোগ্রাফার কিভাবে পৃথিবীকে দেখেন সেটার manifestation – আর সেই ব্যক্তিগত পৃথিবীতে ছোট বড় সবকিছুই মহাকাব্য রচনা করার ক্ষমতা রাখে।

 

‘দেখার চোখ’ গড়ে তোলা

আশেপাশের পৃথিবীকে একটু অন্যরকম ভাবে দেখা, একটু নিজের মতো করে দেখা – এই ব্যপারটা যার মধ্যে আছে, তার মধ্যেই একজন ফটোগ্রাফার আছে। অনেকে হয়তো ক্যামেরা হাতে নেয়ার পর ব্যপারটা উপলব্ধি করেন- তারা ভাগ্যবান। অনেকের হয়তো সেই সুযোগ হয় না – এক জীবন কেটে যায় সৃজনশীল একটা সত্ত্বা নিয়ে, যার প্রকাশ ঘটেনা কখনও।

এইযে পৃথিবীকে একটু অন্যরকম ভাবে দেখা – সেটা কি মানুষ জন্ম থেকে নিয়ে আসে? না, আসে না। এই ব্যপারটি অনেকখানি নির্ভর করে শৈশবে আপনি কি রকম পরিবেশে বড় হয়েছেন তার উপর। আমরা জানি যে অনেক সঙ্গীত শিল্পীর সন্তানরাও ভাল শিল্পী হন, অনেক ফটোগ্রাফারের সন্তানেরা ফটোগ্রাফীকে আঁকড়ে ধরেন। এরকম উদাহরণ হাজার হাজার আছে, যদিও বলিউডের পরিবারতন্ত্রের ঘোর বিরোধী আমি- হা হা। তবে তার মানে এই নয় যে পরিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড থাকতেই হবে। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই শিল্পীসত্ত্বা ঘুমন্ত আছে – কে আছে যে গান শোনে না? সিনেমা/নাটক দেখে না? মূল বিষয়টি হলো আগ্রহের যায়গাটিতে লেগে থাকা। প্যাশনটা বেশি জরুরী। যাই হোক – ফটোগ্রাফীর চোখ গড়ে তোলার জন্য নিচের বিষয়গুলো আমার মতে অনেকখানি সাহায্য করতে পারে –

১. প্রচুর ছবি দেখা – হ্যাঁ, খুবই কাজে দেয়। তবে সবার ছবিই যে দেখতে হবে, তা কিন্তু নয়। অনেক শিক্ষানবিশ ফটোগ্রাফার আছেন – তাদের কাজ হয়তো মাঝারী মানের। আপনাকে দেখতে হবে Time tested ফটোগ্রাফারদের ছবি, যাদের কাজ জগদ্বিখ্যাত। তাঁরা যেহেতু সেরা ফটোগ্রাফার হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃত, তাদের কাজ দেখলে আপনি নিশ্চিতভাবেই কিছু শিখতে পারবেন। যেই ছবিটিই দেখবেন, মনোযোগ দিয়ে দেখুন – ছবিটির বিশেষত্ব কি? কেন ছবিটির Impact এত বেশি? কম্পোজিশনের কোন রূল ফটোগ্রাফার ফলো করেছেন এখানে? ছবিটি কি আপনি হলে অন্য কোনভাবে তুলতেন? এই প্রশ্নগুলো করুন – মনে মনে তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করুন।

২. বই পড়ুন – বিশেষ করে উপন্যাস। বইয়ের শব্দের গাঁথুনির অন্যতম উপাদান হলো ‘ডিটেইলস’ | খেয়াল করলে দেখবেন একজন লেখক কোন ছো্ট বিষযের বর্ণনা দেয়ার সময়ও অনেক পারিপ্বার্শিক ডিটেইলস তুলে নিয়ে আসেন। যখন তিনি একটা সকালের বর্ণনা দেন তখন চায়ের কাপের ধোঁয়া, পাতায় প্রথম রোদের খেলা, দূর্বাঘাসের উপর শিশির বিন্দুর ঝকমকানি – এরকম সব ডিটেইলস এর বর্ণনা দেন। উদাহরণ হিসেবে বিভুতিভুষণ বন্দোপাধ্যায় এর ‘আরণ্যক’ হতে একটা প্যারা তুলে দিলাম:

“আরো মাইলপাঁচেক গিয়া কারো নদী পড়িল, খুব উঁচু বালির পাড় দু-ধারে, অনেকটা খাড়া নিচে নামিয়া গেলে তবে নদীর খাত, বর্তমানে খুব সামান্যই জল আছে, দু-পারে অনেক দূর পর্যন্ত বালুকাময় তীর ধূ-ধূ করিতেছে। যেন পাহাড় হইতে নামিতেছে মনে হইল; ঘোড়ায় জল পার হইয়া যাইতে যাইতে এক জায়গায় ঘোড়ার জিন পর্যন্ত আসিয়া ঠেকিল, রেকাবদলসুদ্ধ পা মুড়িয়া অতি সন্তর্পণে পার হইলাম। ওপারে ফুটন্ত রক্তপলাশের বন, উঁচু-নিচু রাঙা-রাঙা শিলাখণ্ড, আর শুধুই পলাশ আর পলাশ, সর্বত্র পলাশফুলের মেলা। একবার দূরে একটা বুনো মহিষকে ধাতুফুলের বন হইতে বাহির হইতে দেখিলাম-সেটা পাথরের উপর দাঁড়াইয়া পায়ের ক্ষুর দিয়া মাটি খুঁড়িতে লাগিল। ঘোড়ার মুখের লাগাম কষিয়া থমকিয়া দাঁড়াইলাম; ত্রিসীমানায় কোথাও জনমানব নাই, যদি শিং পাতিয়া তাড়া করিয়া আসে? কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয়, সেটা আবার পথের পাশের বনের মধ্যে ঢুকিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল।”

পড়ে দেখুন – কি পরিমাণ ডিটেইলস তিনি তুলে ধরেছেন! বই পড়লে পৃথিবীকে এইভাবে দেখার ক্ষমতা আপনারও তৈরী হবে। আর ফটোগ্রাফীতে ছোটখাট ডিটেইলস যে কত গুরুত্বপূর্ণ সেটা তো একটু আগেই আলোচনা করেছি। শুধু তাই নয়, বই পড়লে আপনার নিজস্ব জীবনদর্শন তৈরী হবে – যেটা যে কোন শিল্পমাধ্যমেই উৎকর্ষ সাধনের জন্য অপরিহার্য।

শুধু বই পড়াই নয়, অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের জন্য appreciation গড়ে তুলুন নিজের মধ্যে – সেটা হতে পারে পেইন্টিং, ভাস্কর্য, পারফর্মিং আর্ট ইত্যাদি সবই। মানুষের সব Creative Expression এর উৎস আসলে একই – কিন্তু এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে এখানে!

৩. মানুষের অভিব্যক্তি স্টাডি করুন – মানুষের ছবি তোলার একটা পূর্বশর্ত হচ্ছে মানুষের ‘বডি ল্যাংগুয়েজ’ বুঝতে শেখা – বিশেষ করে মুখের অভিব্যক্তি। ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তি ভিন্নভিন্ন মানসিক অবস্থাকে তুলে ধরে, সেই জিনিসগুলো বুঝতে হবে। অনেকসময় খুব ‘subtle’ অভিব্যক্তিকে ছবিতে ধরে রাখা সম্ভব, কিন্তু আগে সেটা আপনাকে চোখে ধরতে হবে। নিচের উদাহরণগুলো লক্ষ্য করুন:

If I could Read [..Dhaka, Bangladesh..]

Those Eyes can [..Sylhet, Bangladesh..]

A tiresome Journey [..Dhaka, Bangladesh..]

The Spellbound souls-15

প্রথম ছবির অভিব্যক্তি একেবারেই ‘obvious’ না, কিন্তু এটা খুব স্পষ্টভাবেই মেয়েটির মানসিক অবস্থাকে তুলে ধরছে। পরের ছবিটিতে আবার চোখেমুখে হাসি! খেয়াল করলে দেখবেন, মানুষের অভিব্যক্তির অনেকখানি প্রকাশ পায় চোখে।

যেহেতু একটা ছবি আসলে একটা মুহুর্তের ‘snapshot’, কাজেই আপনাকে মনে রাখতে হবে ঠিক কোন অভিব্যক্তিটি ক্যামেরায় ধরলে আপনি সাবজেক্টের মানসিক অবস্থাকে সঠিকভাবে রিপ্রেজেন্ট করতে পারবেন। ঠিক সময়মত শাটার টিপতে হবে, কিন্তু তার আগে বুঝতে হবে সঠিক সময়টা।

৪. বিগ পিকচার (Big Picture) দেখতে শেখা: একটু আগে ডিটেইলস এবং ক্ষুদ্রের শক্তি নিয়ে কথা বলেছি। উল্টোটাও কিন্তু সমান গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বড় বিষয়বস্তুও কিন্তু খুব সরল এবং শক্তিশালী মেসেজ দিতে পারে। আপনার ছবিতে বিষয়বস্তুর কাজ হলো এফেক্টিভলী একটা বার্তা দর্শকের কাছে পৌছেঁ দেয়া, সেটা পাহাড় দিয়েও দেয়া যায়, আবার পাথর দিয়েও দেয়া যায়।

দু’একটা উদাহরণ:

Kuakata- the epitome of human resilience

এই ছবিতে দু’টো বাচ্চা খেলছে সমুদ্র সৈকতে। আরো জুম করে তোলা যেত, কিন্তু সেক্ষে্ত্রে আমরা এনভায়রনমেন্টের বিশালতা দেখাতে পারতাম না।

Skywalkers

একই ধরনের কথা এই ছবিটার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নৌকাবাইচের দর্শকরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে ব্রীজের উপর। ক্লোজআপ নিলেও ছবির বিষয়বস্তু একই থাকতো, কিন্তু পরিবেশের বিশালতা এবং মানুষের উদ্যমকে ধরা যেত না।

 

আজকে এ পর্যন্তই। ছবি দিয়ে গল্প বলার গল্প দিয়ে আগামী লেকচারে শেষ হবে বেসিক ফটোগ্রাফীর এই কোর্স। আপনাদের সবার জন্য শুভকামনা!

Comments

comments

About the author

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান

আমি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, পেশায় অণুজীববিজ্ঞানী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক, বর্তমানে অ্যামেরিকায় University of Tennessee, Knoxville এ পিএইচডি করছি একই বিষয়ে। বন্ধু বান্ধব, পরিবারপরিজন সবাই মনির নামে চেনে…বহু কষ্টে এখানে আমার অ্যামেরিকান প্রফেসর এবং বন্ধুবান্ধবের মাথায়ও এই নামটাই ঢুকিয়ে দিয়েছি, যেন বহুল পরিচিত মোহাম্মদ নামে না ডাকে আমাকে। ফটোগ্রাফী শুরু করেছিলাম ২০০৬ এর শেষের দিকে, এর পরই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়লাম…সেই ভালবাসা এখনও অটুট। প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা না থাকলেও বেশ কিছু প্রদর্শণী ও প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহন করেছি, কিছু স্বীকৃতিও পেয়েছি।

ফ্লিকার এ শেয়ার করি আমার বেশিরভাগ ছবি, এই লিংক এ: www.flickr.com/bacillus

ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট এখানে: www.talkativepictures.com

Leave a Reply