«

»

মার্চ 04

দাবা খেলা পরিচিতি লেকচার ১৪,৩ – দুর্বল ঘর সম্বন্ধে জানুন

আমরা আগের লেকচারে দেখেছি একদম মুক্ত (open) বোর্ডে কেন্দ্র দখল ও ঘুটির বিকাশে অনেকটা এগিয়ে থাকলে ভালো আক্রমণের সুযোগ পাওয়া যায়। এরকম আক্রমণ প্রতিহত করতে প্রতিপক্ষকে অনেক বেকায়দায় পড়তে হয়। এবং আক্রমণ সামলানোর পথে অনেক সময় বড় ঘুটি খুইয়ে বসতে হয়।

গ্যামবিটের উদাহরণে দেখেছি ঘুটির বিকাশে এগিয়ে থাকা স্বল্পমেয়াদী সুবিধা, কারন প্রতিপক্ষকে কয়েকটা চালের সুযোগ দিলে প্রতিপক্ষ ঘুটির বিকাশ সম্পুর্ণ করে ফেলতে পারে, তাই প্রতিটা চাল (tempi) অসম্ভব গুরুত্বপুর্ণ। কারন “A pawn is worth three tempi”

অপরপক্ষে, কারো বোড়ের গঠন খারাপ হলে তা সাধারণত দীর্ঘমেয়াদী দুর্বলতা, কারন বোড়ের গঠন খুব সহজে পরিবর্তিত হয় না। একই রকম ভাবে, কোন দরকারী ঘরের দখল অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা হয়ে উঠতে পারে।

এবার আমরা একটু অন্য রকমের পজিশন সম্বন্ধে আলোচনা করবো। ধরা যাক পজিশন বেশ বদ্ধ (closed), এবং প্রতিপক্ষের কোন ঘুটি সরাসরি আক্রমণের সুযোগ নেই। সেই অবস্থায় খেলা কি ভাবে পরিচালনা করা যেতে পারে তার দু একটা উদাহরণ দেখবো।

মুক্ত পজিশনের তুলনায় বদ্ধ পজিশনে tempi অনেক কম ক্রিটিক্যাল, বরং ভালো জায়গায় ঘুটির অবস্থান অনেক বেশি গুরুত্বপুর্ণ। উদাহরণ হিসাবে আমরা দুর্বল ঘর (weak square) সম্বন্ধে শিখবো।

দুর্বল ঘর কি? বোর্ডের কোন ঘরকে সাধারণত বোড়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সাধারণত সেই ঘরকে দুর্বল ঘর বলা হয়। নিচে একটা উদাহরণ দিলাম।

দুর্বল ঘর

lecture14.3.1

 

উপরের পজিশন টা সাধারণত সিসিলিয়ান ডিফেন্স থেকে আসতে পারে।

1.e4 c5 2.Nf3 Nc6 এর পর বোর্ডের পজিশন ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন। এই অবস্থায় সাদার কাছে অনেক চাল আছে। কোন ডাটাবেস দেখলে দেখতে পাবেন এই অবস্থায় সবচেয়ে জনপ্রিয় চাল হলো 3.d4.  এছাড়া 3.Bb5, 3.Nc3, 3. c3 ইত্যাদি চাল বেশ জনপ্রিয়।

ধরুন আপনি কালো নিয়ে খেলছেন। খেলায় সময় সাদার থেকে আপনি হয়তো এই চালগুলোর মধ্যে কোন একটা চাল আশা করবেন। কিন্তু সাদা এই চালগুলোর কোন একটাও না খেলে অন্য একটা চাল খেললো। তা হলো 3.c4.  এর পর নিচের পজিশন টা তৈরি হবে।

lecture14.3.2

 

 

এবং খেলার মাত্র ৩ চালের পর আপনি একটা নতুন পজিশনে এসে পৌছেছেন। আপনি হয়তো ভাবছেন এটা খুব একটা ভালো চাল হতে পারে না, কারন খুব ভালো চাল হলে এই চালটা অনেক বেশি জনপ্রিয় হতো। কিন্ত এর পর কিভাবে খেলা পরিচালনা করতে হয়ে  তা আপনার জানা নেই।

এটা একটা উদাহরণ মাত্র। আপনি নতুন খেলোয়াড় তাই সাদার তৃতীয় চালের পর আপনার আর পজিশন সম্বন্ধে কোন ধারণা নেই। একজন গ্রান্ডমাস্টার এর ক্ষেত্রে এরকম অজানা পজিশন হয়তো ২৩ চাল পর আসবে। কিন্তু একটা সময়ের পর সবাইকে নিজে থেকে ভাবনা শুরু করতে হয়, এবং একটা মোটামুটি ভালো পরিকল্পনা করে খেলা কে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়।

3.c4 চালটি খুব একটা জনপ্রিয় নয়। তার কারন আছে। সবচেয়ে সহজ কারন হলো, এই চালের পর সাদার d4 ঘরের উপর দখল কমে গেছে। অনেকে খেলার শুরুতে বোর্ডের কেন্দ্রে লাইন মুক্ত করতে চান না, তাই এরকম ভাবে খেলা শুরু করেন। এরপর অনেক সময় সাদা ডি৩ চালের মাধ্যমে কেন্দ্রের বোড়ের ভিত শক্ত করেন।

এরপর খেলা অনেক ভাবে পরিচালনা করা যেতে পারে। আমি একটা সহজ পরিকল্পনার উদাহরণ দিচ্ছি। এটা সবার জন্য বোঝা খুব সহজ হবে।

আপনি আপনার বাকি ঘুটির বিকাশের সময় সাদার ডি৪ ঘরকে টার্গেট করতে পারেন। বিশেষ করে সাদা যদি d2-d4 বোড়ে চাল দিতে না পারে তবে d4 ঘরের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা কঠিন। দু পক্ষেরর কয়েকটা সাধারণ ঘুটি বিকাশের চাল দেওয়া যাক। ধরা যাক খেলাটা এমন ভাবে এগোলো।

1. e4 c5 2. Nf3 Nc6 3. c4 g6 4. d3 Bg7 5. Nc3 d6 6. Be3 Bg4 7. Be2

 

এবং আমরা নিচের অবস্থানে পৌছলাম।

lecture14.3.3

গজ জোড়া থাকলে সাধারণত দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা পাওয়া যায়। বিশেষত মুক্ত বোর্ডে গজ খুব কার্যকরী হয়। তবে উপরের পজিশন টি বেশ বদ্ধ, এবং কেন্দ্র খুব শীঘ্র মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই এই অবস্থায় গজ জোড়া একটা মুক্ত বোর্ডের মতো কার্যকরী হবে না। তাই সাদার ঘোড়ার বদলে কালোর একটা গজ বিনিময় করা যেতে পারে।

এই অবস্থায় কালোর কাছে গজ দিয়ে ঘোড়া খাবার দুটো সম্ভাবনা আছে।

7…Bxf3 আর 7…Bxc3

কোনটা খেলবেন? আর কোনটা খেলবেন না?

ভাবতে চাইলে বাকি অংশটা পড়ার আগে একটু সময় নিয়ে ভাবতে পারেন।

প্রথম পজিশন, 7…Bxf3  এর পর

lecture14.3.4

 

 

দ্বিতীয় পজিশন, 7…Bxc3 এর পর

 

 

lecture14.3.5

 

 

ঊত্তরঃ প্রথম খাওয়া টা ভালো, কারন, এতে কালোর d4 ঘরের উপর দখল ভালো হবে। দ্বিতীয় খাওয়া টা ভালো নয়, কারন এতে সাদার একমাত্র দুর্বল ঘর d4  ঘর বোড়ে দিয়ে রক্ষা করা সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে সাদার বোড়ে ডাবল হুয়ে গেলেও এটা সাদার জন্য ভালো, কারন ডাবলড বোড়ে বোর্ডের খুব গুরুত্বপুর্ণ ঘর নিয়ন্ত্রণ করছে। তার উপর, কাসল করার পর কালো রাজার পাশে f6/h6 ঘর দুটো দুর্বল, তাই রাজার নিরাপত্তা কমবে। এছাড়া, b-ফাইল বরাবর সাদা নৌকা দিয়ে কালো কে আক্রমনের সুযোগ পাবে। এবং সবার শেষে, দ্বিতীয় খাওয়ার পর এক চালে কালোর খেলার প্রথম থেকে পরিচালনা করা পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য ব্যহত হবে।

সুতরাং এই পজিশনে দ্বিতীয় খাওয়া টা বেশ বড় ভুল (blunder). এতে সরাসরি কোন ঘুটি খোয়া যায় না, তবে দীর্ঘমেয়াদী অসুবিধায় পড়তে হয়। এই ধরনের ভুল কে পজিশনাল ভুল বলা হয়। প্রথম খাওয়া অনেক ভালো চাল।

সাদার d4 ঘরের দখল বেশ সমস্যার। কালো ভবিষ্যতে এই ঘরে একটা ঘুটি (ঘোড়া/গজ) বসিয়ে বোর্ডে সাদার ভাগে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এবং সাদার পক্ষে সহজে এই ঘুটিকে তাড়িয়ে দেবার উপায় নেই। এর ফলে কালো সহজে খেলা জিতে যাবে না, কিন্তু অকারন একটা ঘরের দখল ছেড়ে দেওয়ার পরিপূরণ (compensation) হিসাবে সাদার তেমন কিছু নেই।

এই সমস্ত কারনে টাইটেল ধারী খেলোয়াড়দের খেলায় সাদার এই ধরনের ওপেনিং খেলতে দেখা যায় না। অনেকে যারা এই ধরনের ক্লোজড পজিশন খেলতে পছন্দ করে তারা বরং নিচের মতো করে ঘুটি সাজায়।

lecture14.3.6

 

এখানে সাদার রাজার দিকের ঘোড়া ও গজের অবস্থান লক্ষ্য করুন। d4 এখানেও দুর্বল, তবে কালো Bg4 খেলে সহজে d4 ঘরের উপর অতিরিক্ত দখলের সুবিধা পাবে না। অপরপক্ষে, কাসলিং এর পর সাদা সময়মতো f2-f4 খেলে কেন্দ্র দখলের সুবিধা পাবে।

আপনি যদি ক্লোজড গেম খেলতে পছন্দ করেন তবে এই সেট আপ বেশ ভালো। সাদার এই ধরনের ঘুটি সেট আপ কে বটভিনিক সেট আপ বলে। প্রসঙ্গত, কালো নিয়েও অনেকক্ষেত্রে এই ধরনের সেট আপ সম্ভব।

………………………………………………………………………………………………

কখনও কখনও একাধিক দুর্বল ঘর দেখতে পাওয়া যায়। নিচের ছবিটি দেখুনঃ

lecture14.4.6

 

কালোর কালো ঘরের গজ নেই। আর বেসিরভাগ বোড়ে সাদা ঘরে রয়েছে। ফলে সারা বোর্ড জুড়ে কালো ঘর গুলো দুর্বল হয়ে গেছে।

উপরের পজিশন টা একটা পুরনো খেলা থেকে নেওয়া। কোন ক্যালকুলেশন করার আগে সাদার লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রতিপক্ষের দুর্বল ঘরে আক্রমণ করা। এই অবস্থায় সাদার চাল। খেলা নিচের মতো চলেছিলো।

1.Bb2 Qa3 2.Bb4 Qa4 3.Qf6 double attack (e7,h8)

lecture14.4.7

 

ই৭ ও এইচ৮ – এই দুই ঘরকে একসাথে সামলানো কালোর পক্ষে সম্ভব নয়। এই পজিশনে সাদার পক্ষে খুব সহজেই খেলা জিতে নেওয়া সম্ভব।

কালোর বোড়ে জি৬ এর বদলে জি৭ ঘরে থাকলে হয়তো এতো তাড়াতাড়ি খেলা শেষ হতো না।

Comments

comments

About the author

রাজীব মন্ডল

আমি একজন রসায়নের গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট, কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে স্নাতক ও কানপুর আই আই টি থেকে স্নাতকোত্তর পাঠক্রম শেষ করার পর বর্তমানে মার্কিন মুলুকে জৈব রসায়ন নিয়ে গবেষণারত। দাবা নিয়ে উৎসাহী। উতসাহবশত অনেক পড়াশুনা করেছি। স্কুল কলেজ জীবনে এক আধটা টুর্নামেন্ট খেলেছি, তবে সেগুলোকে খুব সিরিয়াস টুর্নামেন্ট বলে চলে না। তার বাইরে খেলা বলতে ইন্টারনেটে নিয়মিত খেলি এবং তার বাইরে চর্চা ও করি। তবে ইন্টারনেটের বাইরে খুব একটা খেলিনা, বা কোনো খেতাব নেই। পুরোটাই স্ব-শিক্ষা, কোনোদিন অন্য কারো কাছ থেকে তালিম নিইনি, তবে খেলা শেখার পথে বহু লোকের লেখা পড়েছি, যাদের কে আমার শিক্ষক বলা চলে, কারন তাদের ছাড়া খেলা শেখা আমার পক্ষে সম্ভবপর হতো না।

Leave a Reply