লেকচার ভিডিওঃ
আজকে আমরা হাইপোথিসিস, তত্ত্ব এবং সূত্র বা নীতি সম্পর্কে আলোচনা করব। পদার্থবিজ্ঞানের একদম নবীণ শিক্ষার্থীরা হয়ত এখনই আজকের লেকচারের কিছু কথা নাও বুঝে থাকতে পারে। একটু উদাহরণ দিয়ে বলি। ধরা যাক এমন কেউ যে কখনো সাহিত্য খুব একটা পড়েনি। এখন তাকে যদি আলাদা আলাদাভাবে বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য যেমন কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক ইত্যাদির সংজ্ঞা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো হয় সে পুরোপুরি ব্যাপারটা নাও বুঝতে পারে। শুধু মাত্র যখন সে নিজে আলাদা আলাদা করে কিছু কবিতা, উপন্যাস, ছোট গল্প, নাটক এসব পড়বে এবং নিজে নিজে আবিষ্কার করবে তখনই কেবল সে এদের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারবে।
ঠিক তেমনি কেউ যদি আগে কখনো পদার্থবিজ্ঞানের বা বিজ্ঞানের কোনো হাইপোথিসিস, তত্ত্ব, সূত্র/নীতি এসব না পড়ে থাকে তাহলে সে হয়ত আজকের লেকচারের সব কিছু এখনই খোলাসাভাবে বুঝবে না। এদের মধ্যে তুলনাও করতে পারবে না। তবে কিছুটা ধারনা পাবে। যখন আস্তে আস্তে পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব, সূত্র/নীতি সম্পর্কে পড়াশুনা হবে তখনই এদের মধ্যে বিশদভাবে পার্থক্যটা বুঝতে পারা যাবে।
হাইপোথিসিসঃ
এটা একটা ইংরেজী শব্দ। এটার সঠিক বাংলা কি হবে আমি জানি না। তাই ইংরেজী শব্দই ব্যবহার করছি। হাইপোথেসিস নিয়ে বলার আগে আমরা একটু আগের লেকচারে ফিরে যাই যেখানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ধাপগুলো নিয়ে বলা হয়েছিল। ছবিটা দেখঃ
ছবিতে দেখা যাচ্ছে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ধাপগুলোর মধ্যে ‘আনুমানিক সিদ্ধান্ত’ বলে একটা ধাপ আছে। সহজভাবে বললে এটাই আসলে হাইপোথিসিস। এটাকে অনেকে ‘Educated Guess’ ও বলে থাকেন। অর্থাৎ আমরা যা জানি এবং আমরা যা পর্যবেক্ষণ করেছি সেটার ভিত্তিতে নতুন কোনো এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল কি হবে সেটা সম্পর্কে আনুমানিক একটা সিদ্ধান্ত নেয়া। এখন নতুন এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল সেই ‘Educated Guess’ মোতাবেক হতেও পারে অথবা সেটাকে ভুলও প্রমাণ করতে পারে। যদি আগের অনুমান ভুল হয়ে থাকে তখন সেটা সংশোধন করে নতুন আনুমানিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। হাইপোথিসিস যেকোনো বৈজ্ঞানিক গবেষনা বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির খুব গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। যেকোনো হাইপোথিসিসকে অসংখ্য এক্সপেরিমেন্ট এবং যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে যাচাই করা হয়। এভাবে এক্সপেরিমেন্ট, পর্যবেক্ষণ এবং যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে হাইপোথিসিস গ্রহনযোগ্যতা পায়। এই হাইপোথিসিসের উপর ভিত্তি করে নতুন গবেষণার দিক উন্মোচন হয়।
তত্ত্ব বা থিওরী (Theory):
অনেকে হাইপোথিসিস ও সায়েন্টিফিক থিওরীকে এক করে দেখেন। এই ধারনা ভুল। হাইপোথেসিস এতটা সহজে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মর্যাদা পায় না। এক বা একাধিক হাইপোথিসিসের দীর্ঘ দিনের যাচাই বাছাই, এক্সপেরিমেন্ট, ঐ এক বা একাধিক হাইপোথিসিস দিয়ে অসংখ্য ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পা্রা, সেই ব্যাখ্যার সত্যতা যাচাই, যুক্তি-তর্ক এসব স্তর পেরিয়ে যখন বৈজ্ঞানিক সমাজের প্রায় সবার কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পায় তখন সেই হাইপোথিসিস গুলো থিওরীর মর্যাদা পায়। A theory may be called a well supported hypothesis.
বৈজ্ঞানিক সমাজে থিওরী অনেক বিস্তৃত একটা ধারনা। থিওরী প্রাকৃতিক ঘটনা গুলো কেন এভাবেই ঘটে এ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারনা দেয় এবং কোনো সংশ্লিষ্ট এক্সপেরিমেন্ট এর সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণী করে। কোনো বৈজ্ঞানিক থিওরী যত বেশি প্রাকৃতিক ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পারে সেটা তত শক্তিশালী থিওরী। একটা সফল থিওরীকে অবশ্যই সবসময় সংশ্লিষ্ট কোনো এক্সপেরিমেন্ট এর ফলাফল সম্পর্কে সঠিক ভবিষ্যৎ বাণী করতে হবে। আবার সংশ্লিষ্ট কোনো পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলকেও ব্যাখ্যা করতে হবে ঐ থিওরী দিয়ে। যদি কোনো থিওরী সঠিক ভবিষ্যৎবাণী করতে ব্যর্থ হয় অথবা কোনো পরীক্ষার ফলাফল ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয় তখন থিওরীকেই পরিবর্তন, সংশোধন বা পরিবর্ধন করতে হয়।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। পদার্থবিজ্ঞানের কোনো তত্ত্বই সবশেষ কথা নয়। অর্থাৎ কোনো থিওরীই পরম সত্য নয়। পদার্থবিজ্ঞান যতই সামনে এগোয়, এর থিওরীও সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। পদার্থবিজ্ঞানের একটা তত্ত্ব বা নীতি যতই প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন এমন সম্ভাবনা সব সময় থেকে যায় যে হয়ত কোনো এক পরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণের সাথে এই তত্ত্ব সংগতিপূর্ণ নাও হতে পারে। তখন পরিক্ষণের সাথে মিলিয়ে তত্ত্ব/নীতিকে পরিবর্তন, পরিবর্ধণ, সম্প্রসারণ করতে হয়। theory বা তত্ত্ব এর ক্ষেত্রে range of validity (সীমাবদ্ধতা) বলে একটা ব্যাপার আছে। অর্থাৎ কতটুকুর জন্য, কতটুকূ সীমাবদ্ধতার জন্য এটা সত্য। কেননা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় নির্দিষ্ট কিছু শর্তাধীনেই কোনো একটা সুত্র, নীতি বা তত্ত্ব প্রযোজ্য। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে।
নিউটনের থিওরী (বল সম্পর্কিত নিউটনের সূত্র, গতি সম্পর্কিত সূত্র, মহাকর্ষ সূত্র ইত্যাদি) দিয়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের গতি ও বল সম্পর্কিত ঘটনা গুলো ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু যখন বস্তুর গতি আলোর বেগের কাছাকাছি হয়ে যায় তখন নিউটনের সূত্রগুলো আর ঠিকমত কাজ করে না। তখন আইনস্টাইনের থিওরী অফ রিলেটিভিটি দিয়ে এসব ব্যাখা করা যায়। তার মানে কি নিউটনের থিওরী ভুল? আসলে তা না। প্রতিদিনকার জীবনে আমরা যে গতি দেখে অভ্যস্ত সেসবের জন্য নিউটনের সূত্রগুলোই যথেষ্ট। কিন্তু যখন আমাদের আলোর কাছাকাছি বেগে চলমান (আলোর বেগ প্রায় তিন লক্ষ মিটার/সেকেন্ড) বস্তুর হিসাব-নিকাশ করতে হয় তখন আমাদের আইনস্টাইনের থিওরী অব রিলেটিভিটি ব্যবহার করতে হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে নিউটনের থিওরীর একটা সীমা (range of validity) আছে যার বাইরে নিউটনের থিওরী কাজ করে না।
সূত্র/নীতি (Law):
সূত্র বা নীতি দিয়ে আসলে কোনো একটা নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ এর ফলাফল কি হবে সেটা বর্ণনা করা হয় খুবই সংক্ষেপে। যেমন গ্যালিলিওর পড়ন্ত বস্তুর সূত্র।
অভিকর্ষের প্রভাবে বিনাবাধায় পড়ন্ত সকল বস্তু সমান সময়ে সমান দূরত্ব অতিক্রম করে।
এই এক লাইনের কথাটা যেটা বলে সেটা হচ্ছে অভিকর্ষ বলের প্রভাবে যদি বিনা বাধায় দুটো বস্তু একই উচ্চতা থেকে নিচে পড়তে থাকে তাহলে দুটো বস্তুই সমান সময়ে মাটিতে এসে পড়বে। এক্ষেত্রে আমরা বায়ুর বাধাটা নগন্য ধরে নিচ্ছি। অর্থাৎ বায়ুর চেয়ে অনেক অনেক ভারী দুটা বস্তু নিয়ে এই পরীক্ষাটা করলে দেখা যাবে দুটো বস্তুই মাটিতে পড়তে সমান সময় নিচ্ছে।
আমরা যেটা লক্ষ্য করলাম সেটা হচ্ছে এই সূত্রটা একটা নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণকে বর্ণনা করছে। কিন্তু কেন এমন হয়, কিভাবে এমন হয় সেটা কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না। সেই ব্যাখাটা দেবে হচ্ছে এ সম্পর্কিত থিওরী।
এই উদাহরণ থেকে আমরা যে বিষয়টা বুঝতে পারলাম সেটা হল সূত্র কোনো সুনির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ বা ঘটনা কিভাবে ঘটবে সেটা সম্পর্কে বলে কিন্তু কিভাবে ঘটবে, কেন এমন ঘটবে এসব বিস্তারিত বিষয় সম্পর্কে কিছু বলে না।
থিওরীর সাথে সূত্রের একটা বড় পার্থক্য হল থিওরী অনেক বিস্তৃত। কিন্তু সূত্রের পরিধি অনেক সংকীর্ণ। থিওরী বিশদভাবে প্রাকৃতিক ঘটনা ব্যাখ্যা করে এবং সংশ্লিষ্ট কোনো পরীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণী করে। পক্ষান্তরে সূত্র শুধু কোনো ঘটনা কিভাবে ঘটবে সেটা বলে, কেন এমন ঘটবে বা কেন এটা এভাবেই ঘটে থাকে সেটা সম্পর্কে কিছু বলে না এবং সূত্রের ভবিষ্যৎ বাণী করা ক্ষমতা নেই। কোনো প্রতিষ্ঠিত থিওরী অনেক সময় ভুল বলে প্রমাণিত হতে পারে। কিন্তু সূত্র ভুল প্রমাণের কিছু নেই। উদাহরণটা খেয়াল করি। ‘বিনা বাধায় পড়ন্ত বস্তু সমান সময়ে সমান দূরত্ব অতিক্রম করে’ বহু পর্যবেক্ষণে প্রতিষ্ঠিত এই সূত্র ভুল প্রমাণের কিছু নেই। কিন্তু কেন এমনটা ঘটে থাকে সেটা সেই সম্পর্কিত যে থিওরী আছে সেটা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। ইতিহাসেও কিন্তু তাই হয়েছে। একেক থিওরী একেকভাবে গ্যালিলিওর সূত্রকে ব্যাখা করেছে। সবশেষে নিউটনের থিওরী দিয়ে গ্যালিলিওর সূত্র অনেকটা গ্রহনযোগ্যভাবে ব্যাখ্যা করা গেছে। কিন্তু যেহেতু নিউটনের থিওরীরও সীমাবদ্ধতা ছিল, পরবর্তীতে আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরী অফ রিলেটিভিটি দিয়ে আরো পূর্ণাঙ্গভাবে গ্যালিলিওর সূত্র ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
১.বিজ্ঞান হল তত্ত্ব ও পরীক্ষণের একটি চক্র
আনুমানিক সিদ্ধান্ত পর্যায়ে আমরা একটা তত্ত্ব অনুমান করে নেই এবং এ সম্পর্কিত পরীক্ষা চালাই। ত্তত্ব দেয়া হয় নির্দিষ্ট শর্তের অধীনে যে পরীক্ষাগুলো চালনো হয় সেগুলোর ফলাফল ব্যাখ্যা করার জন্য।যদি এই তত্ত্ব নতুন নতুন শর্তের অধীনে নতুন নতুন পরীক্ষা ব্যাখ্যা করতে পারে তবে সেটাকে একটা সফল তত্ত্ব বলা হয়। এভাবে চলতে চলতে একসময় এরকম হয় যে কিছু কিছু পরীক্ষার ফলাফল ঐ তত্ত্ব দিয়ে আর ব্যাখ্যা করা যায় না। তখন আবার তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীদের কাছে পাঠানো হয় সবকিছু। তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা আবার সবকিছু নিয়ে চিন্তা করেন, নিজেদের সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে নতুন একটা তত্ত্ব দেন। তারপর সেটা আবার পাঠানো হয় পরীক্ষার জন্য। যখনই কোনো পরীক্ষার ফলাফল তত্ত্বের বিরুদ্ধে যায় তখনই দরকার হয় তত্ত্ব সংশোধনের। মনে রাখা প্রয়োজন আমরা কিন্তু পরীক্ষার ফলাফল তত্ত্ব মোতাবেক না আসলে তত্ত্ব সংশোধন করি, কিন্তু পরীক্ষণ পরীক্ষণের যায়গায় ঠিক থাকে। তত্ত্বকেই সব সময় পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এভাবে বার বার পরীক্ষা এবং সংশোধনের মধ্য দিয়ে গিয়েই একটি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
২.তত্ত্ব সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার ঘটনার ব্যাখ্যা দেয় এবং পরীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণী করে
এখানে ভবিষ্যত বাণী বলতে বোঝানো হয়েছে যে একটা তত্ত্ব সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা বা ঘটনা যা এখনো ঘটে নি বা যে পরীক্ষাটি এখনো করা হয়নি সেটির ফলাফল কি হবে সেই সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণী করে। অর্থাৎ তত্ত্বকে সব সময় পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হয় এবং একটি সঠিক তত্ত্বকে সবসময় সঠিক ভবিষ্যতৎ বাণী করতে হয়। আরেকটা কথা বলা হয়েছে যে তত্ত্ব ঘটনা বা পরীক্ষার ব্যাখ্যা দেয়। এর মানে হচ্ছে যে তত্ত্বের মাধ্যমে অল্প কিছু নীতি, সূত্র দিয়ে সংশ্লিষ্ট অনেক অনেক ঘটনা/পরীক্ষা ব্যাখ্যা করা যায়। যদি কোনো তত্ত্ব সঠিকভাবে ঘটনা/পরীক্ষার ব্যাখ্যা না দিতে পারে তাহলে সেই তত্ত্বের আসলে কার্যকর কোনো তত্ত্ব নয়। আমরা কেবল এক্সপেরিমেন্ট থেকে অনেক অনেক ডাটা সংগ্রহ করে যদি এই ডাটা গুলোর পেছনের ‘কারণ, কেন, কিভাবে’ এসব ব্যাখ্যা করতে না পারি তাহলে সেটা কোনো সত্যিকার বিজ্ঞান চর্চা হল না। এটাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিও বলে না।
৩.বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলো বার বার করা যাবে
এর মানে হল একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব তখনই সঠিক বলে বিবেচিত হবে যখন তত্ত্ব সম্পর্কিত পরীক্ষাগুলো যে ল্যাবরেটরীতেই করা হোক না কেন, সব সময় একই রকম ফলাফল বা সিদ্ধান্ত দেবে। বিজ্ঞান সকল দেশের সকল বর্ণের সকল গোত্রের সকল মানুষের জন্য। এর কোনো রকম রাজনৈতিক বা ভৌগলিক সীমা থাকবে না। এমনটা কখনো হবে না যে বিজ্ঞানের ঐ পরীক্ষাটা কেবল ঐ ল্যাবরেটরীতেই করা সম্ভব কিংবা নির্দিষ্ট কজনই কেবল ঐ পরীক্ষাটা করতে পারবে। পর্যাপ্ত দক্ষতা, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, দরকারি সুযোগসুবিধা থাকলে যেকোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা যে কেউ যেকোনো ল্যাবরেটরীতেই করতে পারবে।
গ্যালিলিওর পরীক্ষা
ইতালির পিসা শহরে একটা হেলানো টাওয়ার আছে। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও এই হেলানো টাওয়ারে একটা পরীক্ষা করেছিলেন। তিনি একটি হালকা এবং একটি ভারী বস্তুকে এই হেলানী টাওয়ার থেকে একই সাথে, একই সময়ে নিচে ফেলেন। এভাবে নানাভাবে পরীক্ষা করে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন যে মুক্তভাবে পড়ন্ত সকল বস্তু (হালকা কিংবা ভারী) সমান সময়ে সমান দুরত্ব অতিক্রম করে। অর্থাৎ ‘মুক্তভাবে পড়ন্ত সকল বস্তুর ত্বরণ তাদের ওজনের উপর নির্ভর করে না’।
এবার আমরা একটা পাখির পালক আর একটা কয়েনকে একই সাথে নিচে পড়তে দিলাম। অবশ্যই পালক আর কয়েন একই সংগে মাটিতে পড়বে না, কয়েনটি আগে নিচে পড়বে। তাহলে কি গ্যালিলিও ভুল? আসলে এর মানে হচ্ছে গ্যালিলিওর সূত্রের সম্প্রসারণ হতে হবে। যদি পাখির পালক আর কয়েনটিকে আমরা যদি বায়শুন্য পরিবেশে একই সাথে পড়তে দিতাম তাইলে এরা একই সাথে মাটিতে পৌছুত। তাইলে এভাবে বলা যায় গ্যালিলিওর নীতির সীমাবদ্ধতা (Range of validity) আছে। এই নীতি তখনই প্রযোজ্য যখন বায়ুর উর্ধমুখী বল বস্তুর ওজনের তুলনায় নগন্য হবে। তাই পাখির পালকের মত হালকা বস্তুগুলো অথবা প্যারাশুট এই নীতির বাইরে।
প্রতিটি নীতিরই প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা আছে যার বাইরে নীতিটি প্রযোজ্য নয়। পদার্থবিজ্ঞানের অগ্রগতির মাধ্যমে এই নীতির প্রয়োগের সীমা সম্প্রসারিত হয়। পড়ন্ত বস্তু সম্পর্কিত গ্যালিলিওর বিশ্লেষন অর্ধ শতাব্দী পর নিউটনের গতিসূত্র এবং মহাকর্ষ সূত্রের মাধ্যমে সম্প্রসারিত হয়।
পদার্থবিজ্ঞান কেবল কতগুলো নীতি কিংবা তত্ত্বের সংগ্রহশালা নয়। এটি একটি পদ্ধতিও বটে, যার মধ্য দিয়ে আমরা আরো ভালভাবে, আগের চেয়েও স্পষ্টভাবে পাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে পারি, এ সম্পর্কিত কোনো পরীক্ষণের ভবিষ্যৎবাণী করতে পারি। কোনো তত্ত্বই চিরস্থায়ী নয় কিংবা পরম সত্য নয় । তত্ত্বের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সম্প্রসারণ হতে পারে। এই সম্ভাবনা সবসময় থেকেই যায় যে নতুন কোনো পরীক্ষা, পর্যবেক্ষনের কোনো ফলাফল বর্তমান তত্ত্বের সাথে সাংঘর্ষিক হবে। যদি বার বার পরীক্ষণের ফলে যদি তত্ত্ব ও পরীক্ষণের অসামঞ্জস্যতা না কাটে তাহলে প্রয়োজন হয় তত্ত্বের সংশোধন এবং সম্প্রসারণ।