«

»

ফেব্রু. 28

জীব জীবন পরিবেশ ৭: প্রথম জীব কিভাবে এলো?

[কোর্সের মূল পাতা] [নিবন্ধন ফর্ম][পূর্বের লেকচার]

 

ভিডিও লেকচারটি এখান থেকে দেখে নাও

 

প্রথম জৈব অণু

সকল জীবই জৈব অণু দিয়ে তৈরি। ফলে, এটা ধরেই নেয়া যায় যে প্রথম কোষ তৈরির আগেই প্রথম জৈবঅণুগুলি তৈরি হয়েছিল পৃথিবীতে, সম্ভবত ৪ বিলিয়ন বছর আগে। কিভাবে প্রাণের এই জৈবিক এককগুলি তৈরি হয়েছিল? বিজ্ঞানীরা ভাবেন যে বজ্রপাত বা বিদ্যুৎ চমকানো কোন রাসায়নিক বিক্রিয়াকে চালু করে দিয়েছিল এবং ফলে আদি-পৃথিবীতে অজৈব অণু থেকে জৈব অণু তৈরি হয়েছিল। আর বিজ্ঞানীরা এই ধারনায় পৌঁছালেন যে অজৈব অণু থেকে জৈব অণু তৈরি হয়ে এদের একটি তরল মিশ্রণ বা সু্যপ তৈরি হয়েছিল। আর একে প্রমাণ করতে ১৯৫৩ সালে বিজ্ঞানী স্ট্যাইনলি মিলার এবং হ্যারল্ড উরে একটি আদি পৃথিবীর কৃত্রিম রূপ তৈরি করেছিলেন পরীক্ষাগারে। এখানে তাঁরা অজৈব অণু থেকে জৈব অণু তৈরি করে দেখান। পরক্ষাটিতে পৃথিবীর আদি জলবায়ুর বাতাসের মতই মিশ্রণের নিয়ে সেখানে বৈদ্যুতিক ঝলকানি দিয়েছিলেন। একসপ্তাহের মধ্যে অনেকগুলি খুব সাধারন জৈব অণু তৈরি হয়ে গেল! পরীক্ষাটি নিয়ে একটি ভিডিও দেখে নাও:

 

 

যদিও পৃথিবীর আদি জলবায়ুর বাতাসে কিকি ছিল সেটা নিয়ে দ্বিমত আছে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তারপরও পরীক্ষাটি আমাদের দেখিয়েছে যে জৈব অণু শুধুমাত্র জীবিত বস্তু থেকে তৈরি হয়না, বরং অজৈব অণু থেকেই তৈরি হতে পারে, যদি সঠিক আবহাওয়া বা শক্তি প্রয়োগ করা হয়। এর মানে হচ্ছে প্রাণ তৈরির মৌলিক উপাদানের জন্য অন্য কোন জীবের থাকার প্রয়োজন ছিলনা আদি পৃথিবীতে। বরং অজৈব অণু থেকেই তৈরি হতে পারে জৈব বস্তু।

 

মিলার-উরে পরীক্ষা: আদি পৃথিবীর পরিবেশে কিভাবে প্রথম জৈব অণু তৈরি হয়েছিল।

 

সবার প্রথমে কোন জৈব অণু এসেছে? ডিম আগে না মুরগী আগে?

জীবন্ত বস্তু জৈবযৌগ দিয়ে গঠিত যারা জিনগত তথ্য সংরক্ষণ করে এবং বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটায়। আধুনিক জীব ডিএনএ অণু (ডিএনএ নিয়ে আরও বেশি জানতে হলে ছোটদের জিনতত্ত্ব কোর্সটি দেখে নাও) দিয়ে তথ্য সংরক্ষণ করে এবং মূলতঃ প্রোটিন দিয়ে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটায়। মানে হল প্রোটিন এবং ডিএনএ হল জীবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুইধরনের জৈব অণু। তবে, প্রোটিন না ডিএনএ, কোনটা প্রথম পৃথিবীতে তৈরি হয়েছিল? এটা অনেকটা এমন প্রশ্ন: ডিম না মুরগী, কোনটা আগে এসেছে? ডিএনএ প্রোটিন তৈরির তথ্য বহন করে আবার ডিএনএ তৈরিতে প্রোটিন দরকার। তাই এই দুইটি অণুর প্রতিটির একজন আরেকজনকে প্রয়োজন, নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য। কিভাবে এই দুইটি অণুর যেকোন একটি আরেকটির আগে তৈরি হবে তাহলে? তবে কি এমন কোন জৈব অণু কি তবে তৈরি হয়েছিল ডিএনএ এবং প্রোটিনের বদলে যা থেকে পরের দুইটি অণু এসেছে?

 

আরএনএ পৃথিবী তত্ত্ব

কিছু বিজ্ঞানী ভাবেন যে আরএনএ সম্ভবত প্রথমে তৈরি হয়েছিল পৃথিবীতে যা জিনেটিক তথ্য বহন করতে পারে। আজকের দিনেও কিছু ভাইরাসে আরএনএ একমাত্র জৈব অণু যেটা জৈব এবং জিনেটিক তথ্য বহন করে। এমনকি বিজ্ঞানীরা মনে করছেন আদিজীবগুলি শুধুমাত্র আরএনএ’র উপর নির্ভর করেই বেঁচে ছিল, প্রোটিন এবং ডিএনএ পরে উদ্ভুত হয়েছে। কিন্তু কেন আরএনএ’র কথা ভাবছেন বিজ্ঞানীরা? কারন হল, আরএনএ (ডিএনএ’র মতই) জিনেটিক তথ্য সংরক্ষণ এবং বহন করতে পারে এবং মজার ব্যাপার হল, এমনকি আরএনএ কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়াও সম্পাদন করতে পারে (প্রোটিনের মতই)। আর তাই, ডিম-মুরগীর সমস্যাটা আরএনএ অণু সমাধান করে দিচ্ছে, যেখানে দুইটি জৈব অণু তৈরি হওয়ার ব্যাপার ছিল। অন্য প্রমাণাদিও বলছে যে আরএনএ হয়তো সবচেয়ে আদিম জৈব অণু। নিচের ভিডিওটি থেকে আরএনএ পৃথিবী তত্ত্ব সম্বন্ধে আরও অনেককিছু জেনে নাও:

 

কিভাবে আরএনএ’র মত জৈব অণু প্রথম তৈরি হলো সেটা নিয়ে আমরা খুব নিশ্চিত নই। বিজ্ঞানীরা ভাবেন যে লিপিড বা চর্বি অণু অন্যান্য জৈব অণুর চারপাশে জমা হয়ে একটি পর্দা বা মেমব্রেন তৈরি করেছিল। পর্দাটি ভেতরের অণুগুলির সাথে বাইরের পরিবেশের অণুর বিক্রিয়াকে প্রতিরোধ করে রেখেছিল, যেন তারা নতুন কোন যৌগ তৈরি করতে না পারে। এভাবে জৈব অণুগুলি সংরক্ষিত হয়েছে সময়ের সাথে সাথে। আর এভাবেই হয়তো প্রথম কোষটি তৈরি হয়েছিল। নিচের ছবি থেকে দেখে নাও প্রথম কোষ কেমন হতে পারতো:

প্রথম কোষ হয়তো এমন ছিল

 

LUCA

এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে আদিকোষগুলি বেশিরভাগই এরকম ছিল। কিন্তু, বিজ্ঞানীরা ভাবেন, শুধুমাত্র এক্টি এরকম আদিকোষ (অথবা কোষগুচ্ছ) আসলে পরবর্তীতে এখনকার পৃথিবীর সকল জীব তৈরি করেছে। এই একটি কোষকে বলা হচ্ছে Last Universal Common Ancestor (LUCA)। এর অস্তিত্ব সম্ভবত প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে ছিল। এই LUCA হল সবচেয়ে আদি প্রোক্যারিওটিকদের একটি (কম উন্নত, আদি কোষ কে প্রোক্যারিওটিক কোষ বলে)। তাই, এর সম্ভবত কোন নিউক্লিয়াস এবং অন্যান্য পর্দা আবৃত অঙ্গাণু ছিলনা (উন্নত আধুনিক কোষে দুটোই থাকে, এই কোষগুলিকে বলে ইউক্যারিওটিক, যেমন মানুষের কোষ ইউক্যারিওটিক কোষ)। এই LUCA সম্বন্ধে আরও জানতে হলে নিচের ভিডিওটি দেখে নিতে পারো:

 

সালোকসংশ্লেষণ এবং কোষের শ্বসন

আদি কোষ সম্ভবত heterotroph ছিল, অর্থাৎ কোষের কাজ চালানোর জন্য শক্তির উৎস ছিল কোষের বাইরে থেকে গ্রহণ করার মাধ্যমে এবং সেটা ছিল সম্ভবত জৈবিক তরলের মিশ্রণ বা স্যুপ। কিন্তু, প্রায় ৩ বিলিয়ন বছর আগে, একটা অসাধারণ ঘটনা ঘটলো। নতুন ধরনের এক শক্তি গ্রহণের পদ্ধতির উদ্ভব হলো। এই পদ্ধতিটাকে বলে সালোকসংশ্লেষণ যেখানে জীবেরা সূর্যের আলোকে ব্যবহার করে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং পানি থেকে নিজেই খাদ্য তৈরি করে। এদেরকে বলা হয় autotroph। তাহলে এরা নিজেদের জন্য যেমন খাদ্য তৈরি করে আবার অন্যদের জন্যও খাবার দেয়, যারা এই নতুন জীবগুলিকে খায়। আর এই সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরে পরিবেশে একটি দারুণ পরিবর্তন শুরু হল। সালোকসংশ্লেষণের ফলে জীবগুলি অক্সিজেন বাতাসে ছাড়তে শুরু করলো। কিন্তু প্রথমে এই অক্সিজেন বাতাসে জমা হতে থাকাটা দারুণ ক্ষতিকর ছিল (oxygen catastrophe বলা হয়)। কিন্তু কেন? কারন অক্সিজেন আসলে প্রাথমিক বা আদিকোষগুলির জন্য বিষাক্ত ছিল, কারন তারা অক্সিজেন নাই এমন পরিবেশে উদ্ভব হয়েছে, তাই খাপ খাইয়ে নিতে পারছিল না অক্সিজেন আছে এমন পরিবেশে। আর এর ফলে অনেক জীব মরে গেল। যারা বেঁচে ছিল তারা আসলে অক্সিজেন ব্যহারের একটি নতুন পদ্ধতি তৈরি করলো বলেই বেঁচে ছিল। প্রথম জীব তৈরি হওয়ার পরে এটা হল জীবজগতের দ্বিতীয় বৃহৎ এবং অসাধারণ উদ্ভাবন (সালোকসংশ্লেষণ প্রথম)। এই প্রক্রিয়ার নাম শ্বসন। শ্বসন প্রক্রিয়া অক্সিজেন ব্যবহার করে জৈব অণু থেকে জীবের জন্য শক্তি উৎপাদন করে।

 

ইউক্যারিওট (Eukaryote) জীবের বিবর্তন

কোষের ভেতরে বিভিন্ন সুসংগঠিত এবং আবরণীসহ অঙ্গাণুর উপস্থিতি নিয়ে যেসব আধুনিক কোষ তৈরি হয়েছে তাদের ইউক্যারিওটিক কোষ বলে। প্রথম ইউক্যারিওট জীব সম্ভবত ২ বিলিয়ন বছর আগে উদ্ভব হয়েছিল। আর কিভাবে হয়েছিল সেটা ব্যাখ্যা করা যায় এন্ডোসিমবায়োটিক তত্ত্বের (endosymbiotic theory) দ্বারা। এটা বোঝার জন্য আগে নিচের ছবিটা দেখে নাও। যখন বড় কোষ ছোট কোষকে খেয়ে ফেলে তখন এন্ডোসিমবায়োসিস প্রক্রিয়া (endosymbiosis) শুরু হয়। এই পক্রিয়ায় আসলে বড় কোষটি ছোট কোষকে পরিপাক করে ফেলে না, বরং আস্ত রেখে দেয় ভেতরে। আর এর ফলে ছোট কোষটি বড় কোষটির ভেতরে বেঁচে থাকতে শুরু করে এবং একসময় কোষ অঙ্গাণু (organelle) হিসেবে উদ্ভব হয়।

 

সরল কোষ থেকে জটিল কোষে রূপান্তর

 

অর্থাৎ বড় এবং ছোট কোষদুটি একটি অনোন্যজীবিতা বা symbiotic সম্পর্ক (প্রক্রিয়াটির নাম ) তৈরি করলো যেখান থেকে দু্টি কোষই উপকৃত হলো। কোন কোন ছোট কোষ বড় কোষগুলি বর্জ্য ভেঙে শক্তি উৎপাদন করতে পারলো। এবং ফলে তারা শুধু নিজের জন্যই নয় বরং বড় কোষটির জন্যও শক্তি উৎপাদন করে সরবরাহ করতে পারলো। আর এভাবে, ছোট কোষটি মাইটোকন্ড্রিয়া নামক অঙ্গাণুতে রূপান্তরিত হল। আবার অন্য কিছু ছোট কোষ সূর্যের আলোকে ব্যবহার করে শক্তি তৈরি করতে পারলো এবং বড় কোষটির সঙ্গে সেই শক্তি বন্টন করে নিতে থাকলো। এই ছোট কোষগুলিকে আমরা এখন বলি ক্লোরোপ্লাস্ট, আরেকধরনের অঙ্গাণু যা উদ্ভিদে থাকে। এই বিশেষ অঙ্গাণুগুলির সাহায্যে ইউক্যাওটিক কোষগুলি শক্তিশালী এবং অনেক কর্মঠ হয়ে উঠলো। পরবর্তীতে (পরবর্তী এই ২ বিলিয়ন বছরে) তারা আরও অনেক অনেক বড় ধরনের খাপ খাইয়ে নেয়া পদ্ধতির ভেতর দিয়ে গিয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে যৌণ প্রজনন, বহুকোষিয়তা, নির্দিষ্ট কাজের জন্য কোষ তৈরি ইত্যাদি। ফলতঃ ইউক্যারিওটিক কোষ প্রাণী, উদ্ভিদ এবং ছত্রাকের মত আধুনিক জীবে রূপান্তরিত হল।

 

কুইজগুলির উত্তর দিয়ে দাও ঝটপট

Comments

comments

About the author

খান ওসমান

আমি টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকিউলার জেনেটিক্স এর একজন পিএইচডি ছাত্র। কাজ করছি ম্যালেরিয়া জীবাণুর একধরনের প্রোটিন নিয়ে। আমার কাজ মূলতঃ এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির মাধ্যমে প্রোটিনের গঠন নির্ণয়, এর সঙ্গে ম্যালেরিয়া রোগের সম্পর্ক নির্ধারণ এবং ঔষধ তৈরিতে সহায়তা করা ইত্যাদি বিষয়ের উপর। স্নাতক এবং মাস্টাসর্ ডিগ্রী অজর্ন করেছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুজীববিজ্ঞান নিয়ে। আমার বতর্মান ল্যাব এর ওয়েবসাইটে ঢু মেরে দেখতে পারেন এখানে: www.thesgc.org.

Leave a Reply